Chatrapati Shibaji Maharaj "ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ: ভারতের স্বাধীনতার অগ্রদূত ও মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা"
পরিচয়
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা ও শাসক। তিনি ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৬৩০ সালে মহারাষ্ট্রের শিবনারি দুর্গে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা এবং ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতার এক মহান প্রতীক। শিবাজী তার কৌশলী যুদ্ধনীতি, শক্তিশালী প্রশাসন, ও ন্যায়পরায়ণ শাসনের জন্য সুপরিচিত ছিলেন।
শৈশব ও শিক্ষা
শিবাজী মহারাজের পিতা শাহজী ভোঁসলে বিজাপুর সুলতানতের সেনাপতি ছিলেন, এবং তার মা জিজাবাই ধর্মপরায়ণ ও বুদ্ধিমতী নারী ছিলেন। মা জিজাবাই ছোটবেলা থেকেই শিবাজীকে রামায়ণ ও মহাভারতের নীতিশিক্ষা দেন এবং জাতীয়তাবাদের বীজ বপন করেন। শিবাজীর শিক্ষার অন্যতম অংশ ছিল কৌশলগত যুদ্ধবিদ্যা, রাজনীতি এবং প্রশাসনিক দক্ষতা, যা পরবর্তীতে তাকে একজন দুর্দান্ত নেতা হিসেবে গড়ে তোলে।
মারাঠা সাম্রাজ্যের উত্থান
শিবাজী মহারাজ কিশোর বয়সেই রাজনীতি ও যুদ্ধের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৬৪৫ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে, তিনি প্রথম বিজয় হিসেবে তোরনা দুর্গ দখল করেন। এরপর তিনি একে একে পুরন্দর, রাজগড়, এবং সিংগড় দুর্গ দখল করে মারাঠা শক্তিকে শক্তিশালী করেন। তার প্রধান লক্ষ্য ছিল বিদেশি শক্তির হাত থেকে ভারতের মাটি মুক্ত করা এবং একটি স্বাধীন হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।
মুঘলদের সাথে সংঘর্ষ
শিবাজী মহারাজের অন্যতম প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব। তিনি গেরিলা যুদ্ধ কৌশল ব্যবহার করে মুঘল বাহিনীকে একাধিকবার পরাস্ত করেন।
- ১৬৫৯ সালে, আফজল খানের নেতৃত্বে বিজাপুর সুলতান শিবাজীকে পরাস্ত করতে পাঠান। তবে শিবাজী বুদ্ধিমত্তা ও কৌশলে আফজল খানকে হত্যা করেন এবং বিজয়ী হন।
- ১৬৬০ সালে, মুঘল সেনাপতি শাইস্তা খান পুনের রাজগড় দখল করতে গেলে শিবাজী রাতের অন্ধকারে তার প্রাসাদে আক্রমণ করেন এবং শাইস্তা খানের আঙ্গুল কেটে দেন।
- ১৬৬৬ সালে, ঔরঙ্গজেব কৌশলে শিবাজীকে আগ্রা দুর্গে বন্দি করেন, তবে শিবাজী সেখান থেকে পালিয়ে যান এবং পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করেন।
রাজ্যাভিষেক ও প্রশাসনিক দক্ষতা
১৬৭৪ সালে, শিবাজী মহারাজ রায়গড় দুর্গে তার রাজ্যাভিষেক করেন এবং নিজেকে "ছত্রপতি" (সম্রাট) ঘোষণা করেন। রাজ্যাভিষেকের সময় তার বিশাল সাম্রাজ্য, শক্তিশালী সেনাবাহিনী ও প্রশাসনিক কাঠামো স্থাপিত হয়।
প্রশাসনিক সংস্কার:
শিবাজী মহারাজ একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন, যার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল:
- আধুনিক সামরিক ব্যবস্থা: তার সেনাবাহিনীতে প্রধানত মরাঠা যোদ্ধাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং গেরিলা যুদ্ধ কৌশল প্রয়োগ করা হয়।
- দুর্গনীতি: তিনি "দুর্গ রাজনীতি" অনুসরণ করেন, যেখানে প্রতিটি দুর্গ সুরক্ষিতভাবে পরিচালিত হতো।
- কর ব্যবস্থা: নতুন কর ব্যবস্থা চালু করেন, যেখানে "চৌথ" (রাজস্বের ২৫%) ও "সর্দেশমুখি" (১০%) কর নেওয়া হতো।
- ধর্মনিরপেক্ষ শাসন: যদিও তিনি হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তিনি মুসলমানদের প্রতিও সমান আচরণ করতেন এবং মসজিদ ও দরগার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
সমুদ্র শক্তির বিকাশ
শিবাজী মহারাজের অন্যতম বড় কৃতিত্ব ছিল শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন। তিনি। তিনি কানহোজি আংরে-র নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী নৌবাহিনী গঠন করেন, যা বিজাপুর, পর্তুগিজ, ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সফল প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তার নৌবাহিনী ভারতের উপকূল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
১৬৮০ সালের ৩ এপ্রিল ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ পরলোকগমন করেন। তার মৃত্যুর পরও তার আদর্শ ও যুদ্ধনীতি মারাঠা সাম্রাজ্যকে দীর্ঘদিন ধরে শক্তিশালী রেখেছিল। শিবাজীর উত্তরাধিকারী সংভাজী মহারাজ তার পথ অনুসরণ করেন এবং মারাঠা শক্তিকে আরও বিস্তৃত করেন।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ সম্পর্কে কিছু চমকপ্রদ তথ্য
- গেরিলা যুদ্ধের জনক
শিবাজী মহারাজ ছিলেন গেরিলা যুদ্ধ কৌশলের অগ্রদূত। তিনি এমন কৌশল তৈরি করেছিলেন যা মুঘল ও বিজাপুর সুলতানদের বিশাল সেনাবাহিনীকে পরাজিত করতে সহায়তা করেছিল। তার যুদ্ধনীতি আজও সামরিক গবেষণার বিষয়।
- আগ্রা দুর্গ থেকে পালানোর কৌশল
১৬৬৬ সালে, ঔরঙ্গজেব শিবাজীকে আগ্রা দুর্গে বন্দি করেন। কিন্তু শিবাজী এক চালাকির আশ্রয় নেন—তিনি ও তার পুত্র সংভাজী মিষ্টির ঝুড়ির ভেতরে লুকিয়ে পালিয়ে যান। এটি ভারতের ইতিহাসের অন্যতম চতুর পালানোর ঘটনা।
- নৌবাহিনী গঠনের পথপ্রদর্শক
শিবাজী মহারাজ প্রথম ভারতীয় শাসক যিনি একটি শক্তিশালী স্বাধীন নৌবাহিনী গঠন করেন। তার নৌবাহিনী ব্রিটিশ, পর্তুগিজ ও সিদ্দিদের বিরুদ্ধে সমুদ্রের নিরাপত্তা রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
- ধর্মনিরপেক্ষ শাসক
যদিও শিবাজী হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তিনি মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিও সমান সম্মান দেখিয়েছিলেন। তিনি মসজিদ ও দরগার রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন, এবং তার সেনাবাহিনীতে বহু মুসলিম যোদ্ধা ছিলেন।
- কোনও নারীর প্রতি অন্যায় বরদাস্ত করতেন না
শিবাজী মহারাজ নারীদের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনিনি কখনো কোনও নারী বন্দিকে অপমান করেননি এবং শত্রুপক্ষের নারীদেরও যথাযথ সম্মানের সঙ্গে নিরাপদে মুক্তি দিয়েছিলেন।
- শক্তিশালী দুর্গনীতি
শিবাজীর সামরিক কৌশলের অন্যতম বড় দিক ছিল তার "দুর্গ রাজনীতি"। তিনি ৩৫০-এরও বেশি দুর্গ নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ করেছিলেন, যা তাকে শত্রুদের হাত থেকে নিজের রাজ্য রক্ষা করতে সাহায্য করেছিল।
- রাজ্যাভিষেকের সময় "হিন্দু পদপাদশাহী" ঘোষণা
১৬৭৪ সালে, রাজ্যাভিষেকের সময়, শিবাজী নিজেকে "হিন্দু পদপাদশাহী"-র (হিন্দু সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা) নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন এবং ভারতের মাটিকে বিদেশি শাসনের হাত থেকে মুক্ত করার শপথ নেন।
- তাঁর অস্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা
শিবাজী মহারাজ তাঁর অস্ত্রের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। যুদ্ধের আগে তিনি তাঁর তলোয়ার ও অন্যান্য অস্ত্রের পূজা করতেন। এই ঐতিহ্য আজও অনেক মারাঠা পরিবার অনুসরণ করে।
- শত্রুদেরও সম্মান দিতেন
শিবাজী তার শত্রুদের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি আফজল খানের সেনাবাহিনীর মুসলিম সৈন্যদের ক্ষতি না করে তাদের নিরাপদে ছেড়ে দিয়েছিলেন, যা তার মহানুভবতার পরিচয় দেয়।
- বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সামরিক নেতা হিসেবে স্বীকৃত
আজও অনেক সামরিক বিশেষজ্ঞ এবং ঐতিহাসিকরা শিবাজী মহারাজকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কৌশলগত সামরিক নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। তার যুদ্ধ কৌশল ও প্রশাসনিক দক্ষতা আধুনিক যুগেও অনুপ্রেরণার উৎস।
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ শুধু একজন বীর যোদ্ধাই ছিলেন না, বরং একজন দূরদর্শী শাসক, কৌশলী সেনানায়ক ও মানুষের নেতা ছিলেন। তার জীবন ও কর্ম আজও প্রতিটি ভারতীয়কে গর্বিত করে এবং অনুপ্রেরণা জোগায়।
উপসংহার
ছত্রপতি শিবাজী মহারাজ শুধু একজন বীর যোদ্ধাই ছিলেন না, বরং একজন বিচক্ষণ শাসক, কৌশলী রাজনীতিবিদ এবং দূরদর্শী নেতা ছিলেন। তার শাসনব্যবস্থা, সামরিক কৌশল ও নীতিগুলি আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। ভারতীয় ইতিহাসে শিবাজীর অবদান অনস্বীকার্য এবং তিনি চিরকাল জাতীয় গর্বের প্রতীক হয়ে থাকবেন।
Comments