Sri Ramakrishna Paramhansa: The Mystic Saint of India
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস: ভারতের এক মহাযোগী ও মরমী সাধক
ভূমিকা
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬–১৮৮৬) ছিলেন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধর্মগুরু ও মরমী সাধক। তিনি ঈশ্বর লাভের অভিজ্ঞতাকে তত্ত্বের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন এবং সব ধর্মের মধ্যে ঐক্য উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর জীবন ও দর্শন আজও লক্ষ লক্ষ মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস। তাঁর প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও শিক্ষা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
এই প্রবন্ধে আমরা শ্রী রামকৃষ্ণের জীবন, সাধনা ও তাঁর অমূল্য শিক্ষার বিশদ আলোচনা করব।
প্রারম্ভিক জীবন ও আধ্যাত্মিক অনুসন্ধান
জন্ম ও শৈশব
শ্রী রামকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৩৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের কামারপুকুর গ্রামে। তাঁর আসল নাম ছিল গদাধর চট্টোপাধ্যায়। তাঁর বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় এবং মা চন্দ্রমণি দেবী ছিলেন ধর্মপ্রাণ ব্রাহ্মণ।
ছোটবেলা থেকেই ধর্ম ও ঈশ্বরচিন্তার প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল।
ভক্তি ও ধ্যানের মাধ্যমে তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করতেন।
অনেক সময় তিনি গভীর ধ্যানে চলে যেতেন, যা আশেপাশের মানুষকে বিস্মিত করত।
তাঁর পরিবার তাঁকে প্রচলিত শিক্ষা নিতে বললেও তিনি তা গ্রহণ করতে অনিচ্ছুক ছিলেন এবং ছোটবেলা থেকেই ঈশ্বর চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন।
দক্ষিণেশ্বর ও আধ্যাত্মিক উন্মেষ
দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরে প্রবেশ
১৮৫৫ সালে, রামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর কালী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত হিসেবে নিয়োগ পান। সেখানে তিনি মা কালীকে শুধুমাত্র প্রতিমা হিসেবে নয়, সশরীরে অনুভব করতে শুরু করেন।
তিনি মা কালীর প্রতি পরম ভক্তি অনুভব করতেন এবং প্রায়ই চেতনা হারিয়ে ফেলে ভাবসমাধিতে (ত্রান্স) চলে যেতেন।
ঈশ্বরদর্শনের জন্য তিনি প্রচণ্ড আকুলতা অনুভব করতেন।
একদিন, তীব্র আকাঙ্ক্ষার ফলে তিনি মা কালীর সরাসরি দর্শন লাভ করেন, যা তাঁর জীবনকে চিরতরে পরিবর্তন করে দেয়।
এই অলৌকিক ঘটনাগুলোর কারণে অনেকে তাঁকে ঈশ্বরপ্রাপ্ত সাধক হিসেবে মানতে শুরু করেন, আবার অনেকে তাঁকে উন্মাদ ভাবতে লাগলেন।
বিভিন্ন ধর্মীয় সাধনা ও উপলব্ধি
শ্রী রামকৃষ্ণ বিভিন্ন ধর্ম ও মত অনুসরণ করে সরাসরি আধ্যাত্মিক উপলব্ধি লাভের চেষ্টা করেন।
অদ্বৈত বেদান্ত (অহং ব্রহ্ম) – গুরু তোটাপুরি
তোটাপুরি নামে এক সিদ্ধ যোগীর কাছ থেকে তিনি অদ্বৈত বেদান্তের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি নিরাকারে ব্রহ্মের অনুভূতি (নির্বিকল্প সমাধি) লাভ করেন।
যদিও তিনি ব্রহ্মকে নিরাকার রূপে উপলব্ধি করেন, তিনি ব্যক্তিগত ভক্তির পথও গ্রহণ করেন, যা বোঝায় ব্যক্তিগত (সাগুণ) ও অব্যক্ত (নির্গুণ) ব্রহ্ম দুটোই সত্য।
ভক্তি ও বৈষ্ণব ধর্ম – গোবিন্দ রায়
তিনি শ্রী রাম ও কৃষ্ণের উপাসনা করেন।
এক সময় তিনি অনুভব করেন যে তিনি রাধারূপে কৃষ্ণের প্রতি প্রেমে নিমজ্জিত।
ইসলাম ও খ্রিস্টধর্মের অভিজ্ঞতা
তিনি ইসলাম ধর্মের নিয়ম পালন করে আল্লাহর উপাসনা করেন এবং স্বপ্নে পয়গম্বর মহম্মদের দর্শন লাভ করেন।
পরে তিনি যিশু খ্রিস্টেরও দর্শন লাভ করেন, যা তাঁর ধর্মীয় সহিষ্ণুতার শিক্ষা প্রতিষ্ঠা করে।
এই অভিজ্ঞতাগুলি তাঁর মূল মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করে: "সব ধর্মই একই সত্যের দিকে পরিচালিত করে।"
বিবাহ ও সারদা দেবীর ভূমিকা
২৩ বছর বয়সে, রামকৃষ্ণের বিবাহ হয় সারদা দেবীর সঙ্গে।
যদিও তাঁদের দাম্পত্য জীবন ছিল নির্ভেজাল আধ্যাত্মিক, তিনি সারদা দেবীকে দেবী জ্ঞানে পূজা করতেন।
সারদা দেবী পরে "মা সারদা" নামে পরিচিত হন এবং রামকৃষ্ণের শিক্ষা প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ ও বিশ্বব্যাপী প্রভাব
শ্রী রামকৃষ্ণের অন্যতম প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বাণী ও আদর্শকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেন।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রথমে সংশয়বাদী ছিলেন, কিন্তু রামকৃষ্ণের সরাসরি অভিজ্ঞতা তাঁকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে।
পরে তিনি রামকৃষ্ণের শিক্ষা অনুযায়ী বিশ্বব্যাপী ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মানবসেবার প্রচার করেন।
১৮৯৭ সালে স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন, যা আজও শিক্ষা, ধর্ম ও মানবসেবার জন্য কাজ করছে।
শিক্ষা ও দর্শন
শ্রী রামকৃষ্ণের শিক্ষাগুলি সহজ, কিন্তু গভীর।
১. সব ধর্মই এক লক্ষ্যে পৌঁছায়
"যতো মত, ততো পথ" – তিনি বিশ্বাস করতেন যে সব ধর্মই ঈশ্বরের বিভিন্ন পথ মাত্র।
২. বই পড়ার চেয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ
তিনি বলতেন, "মধুর স্বাদ কেমন, তা শুধু পড়ে জানা যায় না, স্বাদ নিতে হয়।"
৩. গুরুর গুরুত্ব
তিনি বলতেন, "সৎগুরু ছাড়া সত্যের সন্ধান পাওয়া কঠিন।"
৪. ঈশ্বরের প্রতি প্রেম ও ত্যাগ
তিনি বলেন, "যার মন সংসারে নিমগ্ন, সে ঈশ্বরকে পাবে না।"
৫. সকল জীবের মধ্যে ঈশ্বরকে দেখা
তিনি শেখাতেন, "মানুষের সেবা করো, এতে ঈশ্বরের সেবা হবে।"
শেষ দিন ও মহাসমাধি
১৮৮৫ সালে, রামকৃষ্ণ কণ্ঠের ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।
তবুও, তিনি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত শিষ্যদের শিক্ষা দিতে থাকেন।
১৮৮৬ সালের ১৬ই আগস্ট তিনি মহাসমাধিতে লীন হন।
তাঁর শিষ্যরা, বিশেষ করে স্বামী বিবেকানন্দ, তাঁর শিক্ষা প্রচার করে সারা বিশ্বে প্রসারিত করেন।
উত্তরাধিকার ও প্রভাব
শ্রী রামকৃষ্ণের শিক্ষা আজও বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন আজও শিক্ষা, ধর্মপ্রচার ও সমাজসেবার মাধ্যমে তাঁর আদর্শ রক্ষা করে চলছে।
তাঁর দর্শন ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ঈশ্বরের সরাসরি অভিজ্ঞতা ও নিঃস্বার্থ সেবার বার্তা বহন করে।
শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের অনুপ্রেরণাদায়ক উক্তি
১. ঈশ্বর ও ভক্তি সম্পর্কে
"যে যেমন ভাবে ঈশ্বরকে ডাকবে, তিনি তেমন ভাবেই সাড়া দেবেন।"
"যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে ঈশ্বরকে ডাকবে, সে অবশ্যই তাঁকে লাভ করবে।"
২. জীবন ও ধর্ম সম্পর্কে
"যত মত, তত পথ।"
"ধর্মের মূল কথা ঈশ্বর-সাক্ষাৎকার, কেবল তত্ত্বচিন্তা নয়।"
৩. প্রেম ও সেবার গুরুত্ব
"জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।"
"মানুষের প্রতি ভালোবাসাই ঈশ্বরের প্রতি ভালোবাসা।"
৪. আত্মজ্ঞানের শক্তি
"নিজেকে জানা মানে ঈশ্বরকে জানা।"
"জানতে হবে, আমি কে? তারপরই সব সমস্যার সমাধান হবে।"
৫. বিশ্বাস ও আত্মসমর্পণ
"যে নিজের সব কিছু ঈশ্বরের হাতে সমর্পণ করে, তার আর কোনো ভয় থাকে না।"
"বিশ্বাস এমন হওয়া উচিত যেন ঈশ্বরের হাতের তালুতে তুমি শিশু।"
৬. সংসার ও মোক্ষ সম্পর্কে
"যদি পদ্মপাতার মতো সংসারে থেকেও অসংসারী হতে পারো, তবে মুক্তি নিশ্চিত।"
"সংসারে থেকেও যদি হৃদয়ে ঈশ্বরের নাম থাকে, তবে মুক্তি সুনিশ্চিত।"
শ্রী রামকৃষ্ণের এই উক্তিগুলি আজও মানুষের জীবনকে আলোকিত করে চলেছে। তার শিক্ষা শুধু ধর্মীয় নয়, জীবনের সব ক্ষেত্রেই অনুপ্রেরণা দেয়।
উপসংহার
শ্রী রামকৃষ্ণ ছিলেন জীবন্ত ঈশ্বরসাক্ষাত্কারী সাধক।
তাঁর জীবন ও শিক্ষা ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, ঈশ্বরপ্রেম ও মানবসেবার মূর্ত প্রতীক।
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বার্তা বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন।
"করুণা, ভক্তি ও সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরকে অনুভব করা যায়।" – শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস
Comments